লেখক : ইউনুস আহমেদঃ
বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ যুদ্ধ দ্বারাই ইসলামের সুমহান মর্যাদা, মাহাত্ম্য এবং শৌর্যবীর্যের সূচিত হয়। এ যুদ্ধ কোনো বৈষয়িক ও পার্থিব সাজসরঞ্জাম ব্যাতিত নিছক মহান আল্লাহ তায়ালার রহমত ও করুণায় ইসলামের বিপুল শক্তি অর্জিত হয় এবং কুফর শিরকের শিরে এমনই কঠিন ও কঠোর প্রহার পতিত হয় যে, কুফরের মস্তিষ্ক উপরি হাড় ভেঙে চুর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। এ যুদ্ধ নিছক কোনো কোনো লড়াই নয় বরং এটি হচ্ছে সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী, হক ও বাতিলের মাঝে বিভক্তিরেখা চিহ্নিত কারী প্রক্রিয়া।
নবীজি সাঃ মক্কা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে মদিনায় একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল পেল।সেখানে তারা নিশ্চিন্তে দ্বীন পালন ও অন্যদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিচ্ছেন। এটা মক্কার মুশরিকদের কাছে সহ্য হচ্ছিল না।মুসলমানদের কীভাবে মদিনা থেকে উৎখাত করা যায় তা নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নাই। ভেতরে ভেতরে তারা ষড়যন্ত্রের ছক কষতে লাগলো। তাদের একটি বাণিজ্য কাফেলা ছিল সিরিয়ায়।কাফেলাটি ফিরে আসলে বিপুলসংখ্যক অর্থকড়ি জমা হবে , এবং তা দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র কিনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার দিন গুনছিল তারা। রমজান মাসের সূচনায় রাসুল সাঃ নিশ্চিতভাবে অবহিত হলেন যে, আবু সুফিয়ান কুরাইশের এক বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কায় ফিরে যাচ্ছে। কাফেলার সদস্যসংখ্যা ৩০ বা ৪০ জন, উট রয়েছে এক হাজার। বলতে গেলে সম্পদের একটি বৃহৎ অংশ এখানে রয়েছ।
নবীজি সঃ ভাবলেন এখনই যদি কুরাইশদের এ কাফেলা বাধা দেওয়া না যায়, তাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি দুর্বল করা না যায়, তাহলে দু’দিন পরে তাঁরা মদিনায় হামলা করতে চলে আসবে। আর এখনই তাদের থামিয়ে দিলে মদিনার দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস করবে না। নবীজি সঃ মুসলমানদের নির্দেশ দিলেন, এটি কুরাইশদের ব্যবসায়ী কাফেলা,যা ব্যবসায়ী পণ্যে ভরপুর। তোমরা এ কাফেলার গতিরোধ করার লক্ষ্যে বের হয়ে যাও। হতে পারে আল্লাহ তোমাদের এ কাফেলা গণিমত হিসেবে দান করবেন।
যেহেতু কারো অন্তরে যুদ্ধের কোনো ধারণা ছিল না, তাই তারা যুদ্ধের সামান্যতম প্রস্তুতিহীন বের হয়ে পড়েন। অপরদিকে আবু সুফিয়ান হিজাযের কাছাকাছি এসে গুপ্তচর মারফত আশপাশের খবর নিতে লাগলো। কোনো পথচারী দেখলেই খবর জিজ্ঞাসা করছিল। একপর্যায়ে জানতে পারলো যে, রাসুল সাঃ সাহাবিদের নিয়ে এই কাফেলা অবরুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। এ খবর শুনে আবু সুফিয়ান বিলম্ব না করে মূহুর্তে যামযাম গিফারি কে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কায় পাঠিয়ে দেয়। তাকে বলে দিল যে,তুমি কুরাইশদের গিয়ে বলবে, মুহাম্মদ তার সঙ্গীদের নিয়ে কাফেলার পথরোধ করতে বের হয়েছেন। অতএব তারা যেন তাদের সম্পদ রক্ষা করতে এগিয়ে আসে।
যামযাম গিফারি ‘বাতনুল ওয়াদি’ নামক স্থানে এসে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য উটের নাক কেটে উটের পিঠে থাকা হাওদা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিল, নিজের পোশাক ছিঁড়ে গগনবিদারী চিৎকার করে বলতে লাগলো , হে কুরাইশ সম্প্রদায়, তোমাদের বাণিজ্য কাফেলা বিপদের মুখে। মুহাম্মদ তার সৈন্য সাথীদের নিয়ে তোমাদের বাণিজ্য কাফেলার পথরোধ করেছেন। অতএব তাদের সাহায্যে তোমরা এগিয়ে এসো।
যামযাম গিফারির এই অবস্থা দেখে তারা যেভাবে পারলো বেরিয়ে পড়লো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে। কুরাইশের নেতৃস্থানীয় কেউ মক্কায় থেকে গেল না।তারা বেশ প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়ে এলো। এই বাহিনীতে ৯৫০ জন যোদ্ধা ২০০ জন ঘোড়সওয়ার ছিল। সাথে ছিল গায়িকা, যারা ঢোল বাজিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রুপাত্মক গান কবিতা বলে স্বযোদ্ধাদের উন্মত্ত করবে।
তখন রমজান মাস, সবাই রোজাদার। মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন মতান্তরে ৩১৪ জন। পতাকা ছিল ৩ টি। নবীজি সাঃ যুদ্ধের সাদা পতাকাটি মুসআব ইবনু উমাইর রাঃ এর হাতে তুলে দিলেন। কালো দুটির মধ্যে একটি হযরত আলী রা. কে দিলেন এবং অপরটি আনসারী সাহাবিদের মধ্যে রাখলেন। আলী রাঃ বলেন আমাদের কাছে ঘোড়া ছিল মাত্র দুইটি। একটি যুবাইরের কাছে আরেকটি মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদের রাঃ কাছে, আর উট ছিল ৭০ টি। একটি উট দু’তিনজনের মাঝে বন্টন করা হয়েছিল তারা পালা করে সেগুলোতে সওয়ার হতেন।
বদর প্রান্তরের কাছাকাছি সাফরা নামক স্থানে এসে যাত্রাবিরতি করলেন। তখন নবীজি সাঃ খবর জানলেন যে, কুরাইশরা তাদের বাণিজ্য কাফেলা রক্ষা করতে যুদ্ধে সাজে বেরিয়ে পড়েছে। তিনি সাহাবিদের ডেকে পরামর্শ চাইলেন।এবং কুরাইশ বাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত জানালেন। হযরত আবু বকর রাঃ সাথে সাথে দাড়িয়ে গেলেন এবং খুবই চমৎকার ভাবে আবেগঘন ভঙ্গিতে নিজেকে সমর্পণ করলেন। এরপর উমর রাঃ দাড়িয়ে ভালো পরামর্শ দিলেন। অতঃপর মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রাঃ দাড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহ আপনাকে যা জানিয়েছেন আপনি সেভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন, আমরা আপনার সাথে আছি। আল্লাহর কসম, আমরা আপনার সাথে বনি ইসরায়েলের মতো আচরণ করবো না, যেমনটা তারা মূসা আঃ এর সাথে করেছে। তারা মূসা আঃ কে বলেছিল, যান, আপনি আর আপনার রব গিয়ে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে পড়লাম। কিন্তু আমরা বলছি, আপনি ও আপনার রব লড়াই করুন, আমরা আপনার সাথে থেকে লড়াই করব। আরেক বর্ণনায় আসছে যে, আমরা আপনার ডান পাশে দাড়িয়ে যুদ্ধ করব, বামপাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করব, আপনার সামনে দাঁড়িয়ে, আপনার পিছনে দাড়িয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব। নবীজি সাঃ খুশি হলেন,তার জন্য দোয়া করলেন।
এ যথার্থ উত্তরের পরও রাসুলুল্লাহ সাঃ আবারও বললেন তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও। আমি কী করতে পারি! তখন আনসার -সর্দার হযরত সা’দ ইবনে মুআজ রাঃ নবীজির এ কথার মর্ম উপলব্ধি করতে পেরে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি সম্ভবত আনসারদের মতামত জানতে চেয়েছেন? রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, হ্যাঁ। তখন সা’আদ রাঃ বললেন, আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি, আপনাকে সত্য নবী বলে বিশ্বাস করেছি এবং এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করেছি যে, আপনি যে দ্বীন ও শরীয়ত নিয়ে এসেছেন তা সর্বাংশে সত্য। আমরা আপনার সকল কথা শুনব এবং মানব মর্মে আপনাকে মজবুত ওয়াদা ও প্রদান করেছি। ওগো আল্লাহর রাসুল! আপনি মদিনা থেকে এক উদ্দেশ্যে বের হলেও আল্লাহ তায়ালা অপর এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এ অবস্থায় আপনার যা করার ইচ্ছা হয় করুন। যার সাথে ইচ্ছে হয় সম্পর্ক বহাল রাখুন ও যার সাথে ইচ্ছা ছিন্ন করুন। আমরা সর্বাবস্থায় আপনার সাথেই থাকব।
আমাদের সম্পদ থেকে যে পরিমাণ ইচ্ছা গ্রহণ করুন, যে পরিমাণ ইচ্ছা আমাদেরকে প্রদান করুন। আমাদের থেকে আপনি যে পরিমাণ সম্পদ গ্রহণ করবেন তা যেটুকু দিবেন তা থেকে অধিক প্রিয় ও অধিক কাঙ্খিত বলে মনে করি। আপনি যদি আমাদেরকে ‘বারকুল গিমাদ’ পর্যন্তও যেতে বলেন তাহলে আমরা সে পর্যন্ত যেতে রাজী। সে মহান রবের কসম! যিনি আপনাকে সত্য দ্বীন সহ পাঠিয়েছেন, যদি আপনি আমাদেরকে সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়তে বলেন,তাহলে আমরা মুহূর্তও বিলম্ব করব না। তাতে আমাদের মধ্য থেকে একজনও পিছপা হবে না। আমরা শত্রুর মোকাবেলায় লড়াই করতে মোটেই অপছন্দ করি না। আমরা যুদ্ধের ময়দানে বড়ই ধৈর্যশীল, যুদ্ধ চলাকালে সত্যিকার সৈনিক। আমাদের বিশ্বাস, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে আমাদের পক্ষ থেকে এমন কার্য দেখার সুযোগ করে দিবেন, যা প্রত্যক্ষ করে আপনার চক্ষু শীতল হবে। কাজেই আল্লাহর নামে আমাদের নিয়ে সামনে চলুন।
রাসুলুল্লাহ সাঃ সাহাবায়ে কেরামদের পক্ষ থেকে এমন প্রানোৎসর্গী বক্তব্য পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন। বললেন, আল্লাহর নাম নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাও এবং সুসংবাদ গ্রহণ করো। আল্লাহ আবু সুফিয়ান বা আবু জাহল- এ দুই বাহিনীর কোনো একটির ওপর বিজয় দান করার ওয়াদা করেছেন। আল্লাহর কসম, আমি কাফেরদের নিহত হয়ে পড়ে থাকার স্থান গুলো দেখতে পাচ্ছি।
ওদিকে আবু সুফিয়ান খুব সতর্কতার সহিত তার কাফেলা নিয়ে বিকল্প পথ ধরলেন। তিনি বদর কে বামে রেখে সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চল দিয়ে দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে গেলেন। যখন তিনি কাফেলাকে বাঁচিয়ে নিরাপদে সরে আসতে পেরেছেন, তখন কুরাইশ নেতাদের কাছে চিঠি পাঠালেন যে তোমরা তো আত্মীয়স্বজন ও সম্পদ রক্ষা করতে বের হয়েছিলে, আল্লাহ তা হেফাজত করেছেন। অতএব তোমরা মক্কা ফিরে যাও। কিন্তু আবু জাহল বলল, না। বদর প্রান্তে আমরা ৩ দিন থাকব, খাব, গান বাজনা করব, ফুর্তি করব, তারপর ফিরব, এর আগে ফিরব না।
তার কথা শুনে বনু যুহরার সর্দার আখনাস নিজ গোত্রকে সম্বোধন করে বলল,হে বনু যুহরা! তোমরা কেবল তোমাদের সম্পদ হেফাজত করতে বের হয়েছিলে। আল্লাহ সে সম্পদ রক্ষা করেছেন। তাই লড়াই করার কোনো আবশ্যকতা নেই। এ অবস্থায় আবু জাহলের কথায় নিজেদের ধ্বংসের মুখে ফেলার কোন অর্থ হয় না। চলো আমরা ফিরে যায়। তার আহ্বানে বনু যুহরা গোত্রের সকলে সায় দিয়ে ময়দানে উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই চলে গেল।
রাসুল সাঃ সৈন্য সাথীদের নিয়ে বদর প্রান্তরে উপস্থিত হলেন। কাফের দল পূর্বেই উপস্থিত হয়ে পানির উৎসটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং ময়দানে সুবিধামত স্থান বাছাই করে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। মুসলমানরা এ সকল সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।তাদের এলাকাটি ছিল অত্যন্ত বালুময় প্রান্তর, বালিতে হাঁটা চলা ও ছিল অত্যন্ত কষ্টকর, পা বালিতে ডেবে যাচ্ছিল। আল্লাহ তায়ালা এমন পরিস্থিতিতে মেহেরবানীর বৃষ্টি বর্ষণ করে বালু স্থীর করলেন। মুসলমানরা ছোট ছোট গর্ত তৈরি করে পানি ধরে রাখার ব্যাবস্থা করলেন। ফলে অযু গোসলের আর সমস্যা রইল না।
সন্ধ্যা নেমে এলে নবীজি সাঃ আলী রাঃ যুবাইর ইবনে আওয়াম রাঃ সা’আদ রাঃ সহ আরও কয়েকজন সাহাবী কে কাফেরদের খবরাখবর জানার জন্য আশেপাশের এলাকায় পাঠালেন। তারা কাফেরদের দুইজন গোলামকে আয়ত্তে পেয়ে ধরে নিয়ে এলেন এবং আবু সুফিয়ান সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। গোলাম দুটি জানালো তারা আবু সুফিয়ান সম্পর্কে কিছুই জানে না, তবে কুরাইশ দল সম্পর্কে জানে। তারা কুরাইশ দলের পানি সংগ্রহ করে থাকে, তাই পানি সংগ্রহে বের হয়েছিল। সাহাবীরা তাদের কথা মোটেই বিশ্বাস করতে না পেরে মারধর করতে লাগলে তারা বলে আমরা আবু সুফিয়ানের লোক। গোলাম দুটি পূনরায় বলে আবু সুফিয়ান সম্পর্কে কিছু জানি না, সাহাবীরা আবার মারতে থাকে। এ সময় নবীজি নামাজ শেষে সাহাবিদের উদ্দেশ্যে বললেন, তারা যখন সত্য বলেছিল তখন তোমরা তাদেরকে মারছিলে আর যখন মিথ্যা কথা বললো তখন মার দেওয়া বন্ধ করলে।
এরপর রাসুল সাঃ ঐ দুই গোলাম কে জিজ্ঞেস করলেন, কুরাইশ দল এখন কোথায়? তারা জানালো মাকানকাস নামক টিলার পিছনে রয়েছে। পূনরায় জিজ্ঞেস করলো তারা সংখ্যায় কতজন? তারা বললো আমাদের জানা নাই। এরপর নবীজি জানতে চাইলেন, কুরাইশ সর্দার কে কে এসেছে? তাঁরা জানাল উতবা ইবনে রবীআহ ও তার ভাই শায়বা,আবুল বাখতারী ইবনে হিশাম,হাকিম ইবনে হিযাম,নওফেল ইবনে আসওয়াদ, আবু জাহল,উমাইয়া ইবনে খালাফ,হাজ্জাজের দুই পুত্র নুবাইহ ও মুনাব্বিহ, সুহাইল ইবনে আমর এবং আমর ইবনে আব্দুদ। এ নাম শোনে রাসুলুল্লাহ সাঃ সাহাবায়ে কেরামদের দিকে ফিরে বললেন,আজ মক্কা তার সকল কলিজার টুকরাকে তোমাদের নিকট ছুড়ে দিয়েছেন।
হযরত আনাস রাঃ বলেন, যুদ্ধের পূর্বরাত্রে রাসুল সাঃ আমাদের সকলকে ময়দানে নিয়ে গেলেন। কাফের সর্দাররা কে কোথায় মারা যাবে তা আমাদেরকে দেখালেন। তিনি ময়দানে উপস্থিত হয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে করে বলেছিলেন, এটি অমুকের মরণস্থল,এটি অমুকের। এভাবে তিনি প্রত্যেকটি লোকের নাম নিয়ে নিয়ে স্থান নির্দেশ করেন। নবীজি সাঃ যার মরণস্থল যেটা উল্লেখ করছিলেন সে সেই স্থান থেকে সামান্যও দুরে মারা যায়নি।
ফজরের ওয়াক্ত হতেই নবীজি সাঃ সকলকে নামাজের আহ্বান জানালেন। আওয়াজ শোনামাত্রই সকলে নবীজির চারপাশে একত্র হয়ে গেলেন। নামাজ শেষে সবার উদ্দেশ্যে বক্তব্যে আল্লাহর রাস্তায় প্রাণ বিসর্জন ও জান বাজি রেখে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করেন। এরপর রাসুল সাঃ সাহাবায়ে কেরামকে কাতার সোজা করে দাড় করালেন, কাফেরদের কাতার পূর্ব থেকেই প্রস্তুত। দিনটি ছিল রমজান মাসের ১৭ তারিখ, শুক্রবার। একদিকে হকের জামাত এবং অন্যদিকে বাতিলের জামাত ক্রমশ সত্য-মিথ্যায় পার্থক্যকারী যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতি এগিয়ে যাচ্ছিল। নবীজি সাঃ যখন দেখলেন,কাফের সেনাদল পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসছে, তিনি মহান রবের দরবারে দুহাত প্রসারিত করে বললেন, হে আল্লাহ! এ কাফের দল অহংকার ও আত্মগরিমা নিয়ে মোকাবেলা করতে এসেছে। তারা তোমার বিরোধিতা করে, তোমার রাসুল কে অস্বীকার করে। হে আল্লাহ! তুমি যে সাহায্য ও বিজয় দানের ওয়াদা করেছ তা পূর্ণ করো, তাদেরকে এ সকালেই ধ্বংস করে দাও,নিপাত করে দাও।
যুদ্ধের সূচনা
আবু জাহল এর কিছু উত্তেজিত বাক্যবাণে কাফের সেনাদলে এমনই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে যে, উতবা যুদ্ধের পোশাক পরিধান করে পুরোপুরি প্রস্তুত হয় এবং সে তার ভাই শাইবা ও পুত্র ওয়ালিদ কে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নেমে আসে। সেই সাথে মুসলিম সেনাদলের পক্ষ থেকে মোকাবেলায় আসার জন্য উত্তেজনাময় ভাষায় আহ্বান জানাতে থাকে।
মুসলিম সেনাদল থেকে হারেছ এর দুই পুত্র আউফ ও মুআওয়াজ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাঃ ময়দানে এলে উতবা জিজ্ঞেসা করে, তোমরা কারা?তারা বললেন আমরা আনসার। উতবা তখন বলল তোমাদের সাথে কোন কথা নেই। আমরা তো আমাদের সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে লড়তে এসেছি। কাফের কেউ একজন উচ্চস্বরে বলে উঠলো হে মুহাম্মদ! আমাদের সাথে লড়ার জন্য আমাদের সম্প্রদায়ের লোক পাঠাও। নবীজি তখন আনসারদের ফিরিয়ে এনে হযরত আলী রাঃ, হযরত হামজা রাঃ ও হযরত উবাইদা ইবনে হারেছ রাঃ কে মোকাবেলা করার জন্য বের হতে বললেন। তারা সাথে সাথে কাতার হতে বের হয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। চেহারা লোহার টুপিতে ঢাকা থাকায় উতবা আবারও জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা? সাহাবিরা স্ব স্ব পরিচয় দিলে উতবা বললা হাঁ, তোমরা আমাদের সাথে মোকাবেলার উপযুক্ত লোক।
যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। হযরত উবাইদা রাঃ উতবা’র সাথে লড়তে গেলেন।হামজা রাঃ শাইবা’র মোকাবিলায় এবং আলী রাঃ ওয়ালিদের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে এগিয়ে গেলেন। হযরত আলী রাঃ ও হমজা রাঃ এক আক্রমণেই তাদের মোকাবিলা কারীদের খতম করে করে দিলেন। অপরদিকে উবাইদা রাঃ নিজেও আহত হলেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী উতবা কেও আহত করলেন। হযরত আলী ও হামজা রাঃ উভয়ে উবাইদার সাহায্যে এগিয়ে গেলেন এবং উতবা কে নিপাত করার পর উবাইদা রাঃ কে রাসুলের সাঃ সামনে নিয়ে এলেন।
উতবা, শাইবা ও ওয়ালিদ মুসলমানদের হাতে নিহত হওয়ার পর যুদ্ধের ময়দা উত্তপ্ত হয়ে উঠল। যুদ্ধ যখন ঘোরতর হয়ে গেল রাসুল সাঃ এক মুষ্টি কংকর শত্রুদলের প্রতি ছুড়ে মারলেন। সেই সাথে হুকুম দিলেন আক্রমন করো। কংকর ছুড়ে মারার সাথে সাথে মুহূর্তেই কাফেরদের চেহারায় লাঞ্ছনা এনে দিল।প্রতিটি সৈন্য চোখে বালি পড়ায় চোখ মলতে লাগল। আর মুসলমানরা আক্রমণ আরো জোরদার করল। এক মুষ্টি বালি ছুড়ে মারার সাথে সাথে কাফের সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল। ফলে তারা নিহত ও আহত হতে লাগল। মুসলমানরা আহতদের বন্দী করতে শুরু করল।
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ বলেন, আমি ময়দানে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ আমার ডানে ও বামে দুই যুবক, মু’য়াজ ও মুআওয়াজ। একজন আমার কাছে আস্তে করে বলল, চাচা আবু জাহল টা কে আমাকে দেখিয়ে দেবেন? আমি বললাম ভাতিজা, তাকে দেখে তুমি কি করবা? সেই নওজোয়ান তখন আমাকে বলল, আমি আল্লাহর নামে এ প্রতিশ্রুতি করেছি যে, যদি আবু জাহলকে দেখতে পাই তাহলে তাকে হত্যা করব,নাহয় তাকে মারতে গিয়ে নিজে মরব। আমার এ ওয়াদার কারণ, আমি শুনেছি, সে রাসুল সাঃ কে সর্বদাই গালিগালাজ করে থাকে। দ্বিতীয় জনও আমার কাছে এসে আবু জাহল কে দেখিয়ে দিতে বললো, প্রথম জন যে কথাগুলো বলেছিল দ্বিতীয় জনও একই কথা বলল। এরই মাঝে দেখলাম আবু জাহল লোকজনের মাঝে হেটে যাচ্ছে। আমি তাদেরকে দূর থেকে দেখিয়ে দিলাম। দেখামাত্রই তারা দুজন বাজপাখির মতো দৌড়ে তার উপর গিয়ে পড়ল, তাকে তরবারির আঘাতে ধরাশায়ী করে ফেলল। এ অবস্থাতেই তারা পুনরায় দৌড়ে এসে রাসুলুল্লাহ সাঃ কে এ সংবাদ জানাল।
এ যুদ্ধে মুসলমানদের ১৪ জন শাহাদাত বরণ করেন। আর কাফেরদের থেকে ৭০ জন নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দি হয়েছে। সর্বোপরি মুসলমানরা বিজয় লাভ করেন লাভ করেছিলেন।
ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে বদর যুদ্ধ। এ যুদ্ধ থেকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারি।
১. বদর হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী যুদ্ধ । এ যুদ্ধের কারণে হক-বাতিলের পরিচিত এবং সদা বাতিলের বিরুদ্ধে হকের বিজয় সুনিশ্চিত হয়।
২. দোয়ায় শিথিলতা প্রদর্শন না করা: হাদিসের ভাষ্য মতে, দোয়া হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কঠিন বিপদে এমনকি জীবনের চরম মুহূর্তে দোয়ার ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শন না করতে বদর যুদ্ধ আমাদেরকে শিক্ষা দেয়।
৩. সকল কাজে আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা রাখা:
৪. সংখ্যাধিক্য বিজয়ের মূল শর্ত নয়। আল্লাহর ওপর ভরসা করে সততা ও ইখলাস সহকারে তাঁর দ্বীনের পতাকাকে উত্তোলন করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার কারণে সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও তিনি বদর প্রান্তরে মুসলমানদের সফলতা দিয়েছেন।
৫. ঐক্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন: ঐক্য হচ্ছে সফলতা ও বিজয়ের অন্যতম ভিত্তি। আমরা লক্ষ্য করি বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল তাঁদের দৃঢ়পদ অবস্থান, একতা ও অবিচলতা। অন্যদিকে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণকারী কাফিরদের অবস্থা ছিল ভঙ্গুর। ফলে তারা সহজেই পরাজিত হয়েছিল।