চট্টগ্রামের এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল নুরুল আজিম রনি। সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নগর সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বাধ্য হয়ে একসময় পদত্যাগ করলেও অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, মারামারি, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতা—সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অদম্য। কিশোর গ্যাংয়ের কাছে ‘ছাত্রবন্ধু’ খেতাব পাওয়া রনি জনমুখে ‘টোকাই রনি’ নামেই পরিচিত। ‘টোকাই’ ভাড়া করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রামে প্রথম শিক্ষার্থীদের ওপর নারকীয় হামলা ও গুলি চালানোর ‘মাস্টারমাইন্ড’রনি। সরকারের পতন হলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে প্রথমে ভারতে, পরে সেখান থেকে এক নিকটাত্মীয়ের সহযোগিতায় পাড়ি জমিয়েছেন কম্বোডিয়ায়। এখন সেখানে বসে ‘আদম ব্যবসা’ পেতেছেন।
কখনো কিশোর গ্যাং পুষে, কখনো স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলে ‘হিরোইজম’ করে লাইমলাইটে আসা নুরুল আজিম রনি যুবলীগের পদ বাগানোর চেষ্টায় ছিলেন। তবে রনির হিংস্র ও কলংকিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত আওয়ামী লীগ বরাবরই তাকে ‘দূরে’ রেখেছে।
গত ৯ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়েছেন নুরুল আজিম রনি—এমন খবর ছড়ালেও তা ছিল ‘ভুয়া’। মূলত ৫ আগস্টের পর থেকেই দেশ ছেড়ে পালানোর পথ খুঁজতে থাকেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিরোধে অস্ত্র হাতে নেতৃত্ব
কোটা সংস্কারের দাবিতে চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরে গত ১৬ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে তিনজন প্রাণ হারান। ঘণ্টাব্যাপী সেই সংঘর্ষে সেদিন অস্ত্র হাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নুরুল আজিম রনি। ওই সময় শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ করে নানা মন্তব্য করেছেন রনি। নানা উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দিয়ে ক্যাডার বাহিনী নিয়ে মাঠে নামেন। চালান গুলি।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নানা অপকর্মে দল থেকে দূরে থাকা রনি নেত্রীর দৃষ্টি কাড়তে পুঁজি করেন আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে চলা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে। আগবাড়িয়ে ট্রাকে ট্রাকে টোকাই ভাড়া করে অস্ত্র, হকিস্টিক সরবরাহ করেন সবার হাতে হাতে।
সিভয়েস২৪’এর হাতে থাকা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ১৬ জুলাই সংঘর্ষ চলাকালে সম্মুখসারীতে ছিলেন রনি। নির্দেশনা দিতেই শটগান ও অন্যান্য অস্ত্রহাতে পাঁচজন সন্ত্রাসী গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। টি-শার্ট পরে হেলমেট মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন রনি। সেইদিন সংঘর্ষ ব্যাপকতায় রুপ নিলে আরেক অস্ত্রধারী তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ফিরোজ এবং দেলোয়ারও গুলি ছুড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসেন।
দালালির ব্যবসা কম্বোডিয়ায়
বিশ্বস্ত একটি সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর ভারতে থাকা সাবেক এক মন্ত্রীর সাহায্যে দেশ ছাড়েন সন্ত্রাসী রনি। এরপর তিনি কলকাতায় গিয়ে ওঠেন। এর কিছুদিন পরই সেখান থেকে পাড়ি জমান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোচীন উপদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলের দেশ কম্বোডিয়ায়। দেশে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে সেখানে দিন কাটাচ্ছেন ব্যাপক আরাম-আয়েশে।
সূত্রটি জানিয়েছে, সেখানে বসে আওয়ামী নেতাকর্মীদের অযথা ভয়ভীতি দেখিয়ে দেশ ছাড়ার ফাঁদে ফেলে ‘আদম ব্যবসা’ পেতেছেন। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে কম্বোডিয়ায় পারও করেছেন তিনি।
রনির সন্ত্রাসী বাহিনীর চাঁদাবাজি চলছেই
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকার পতনের পর চট্টগ্রাম নগরে থানা ও ফাঁড়িতে হামলা-ভাঙচুরের ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। ‘টোকাই রনি’ যেসব কিশোর গ্যাং নেতার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন তাদের বেশিরভাগই তখন নেমে পড়ে অরাজকতা তৈরির মিশনে। ফুটপাত হতে বিভিন্ন স্থানে করা চাঁদাবাজির টাকার একাংশ রনি খরচ করতেন এসব গ্যাংয়ের পেছনে।
জানা গেছে, নগরের ষোলশহর, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর কেন্দ্রিক মোবাইল ছিনতাইকারীদের বড় একটি গ্রুপ ছিল নুরুল আজিম রনির নিয়ন্ত্রণে। আর সরকার পতনের পর রনি গা ঢাকা দেওয়ায় তারা বেকার হয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে কিছুটা উন্নতি হলেও সন্ত্রাসী রনির বাহিনীর অপকর্ম থেমে নেই। বরং আয় কমে যাওয়ায় তারা এখন আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে।
কে এই রনি?
নগরের এমইএস কলেজের সাবেক জিএস আরশাদুল আলম বাচ্চুর হাত ধরেই রনি ছাত্রলীগে প্রবেশ করেন। তখন আরশাদুল আলম বাচ্চু ছিলেন নগর যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চুর অনুসারী। এক পর্যায়ে বাচ্চুর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে রনি বনে যান নগর ছাত্রলীগের দাপুটে নেতা। এক সময় এরা সকলেই ছিলেন আরেক ছাত্রলীগ নেতা এম আর আজিমের অনুগত।
নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও মেয়র মরহুম এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বদান্যতায় মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন রনি। বর্তমানে রনি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী। – সি’ভয়েস২৪