চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় করা মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরসহ ছয়জন খালাস পেয়েছেন। অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াকে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর ছয় আসামির সাজা কমিয়ে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
এর আগে গত ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় করা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়।
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল সিইউএফএল ঘাট থেকে ১০ ট্রাকভর্তি অস্ত্রের চালান আটক করার পর এ নিয়ে কর্ণফুলী থানায় অস্ত্র আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগ এনে দুটি মামলা হয়। মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় দেন।
এর মধ্যে অস্ত্র চোরাচালান মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী (অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর), সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪ জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। অস্ত্র আইনে করা অন্য মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হয় একই আসামিদের।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রায়সহ মামলার নথিপত্র হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পৌঁছে, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। অন্যদিকে কারাগারে থাকা দণ্ডিত আসামিরা সাজার রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে হাইকোর্টে পৃথক আপিল করেন।
চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক মামলা বাংলাদেশের বড় আকারের জাহাজে আনীত চোরাচালানের মামলা।
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল তারিখে মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বা সিইউএফএল জেটিঘাটে খালাসের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র আটক করে যা পরিবহনের জন্য ১০টি ট্রাক প্রয়োজন হয়েছিল। এই অস্ত্রশস্ত্রের চোরাচালান জাহাজের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে আনা হয়েছিল।
১ এপ্রিল ২০০৪ বাংলাদেশের বন্দর নগরীতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এর জেটিতে ১০ ট্রাক বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটকের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ধরা পড়া অস্ত্র চোরাচালানের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ পরিমাণ। ওই মামলার পাবলিক প্রসিকউটর কামাল উদ্দিন আহমেদের মতে আসামি ছাড়াও এই মামলার কয়েকজন সাক্ষী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য আটককৃত অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশের জলসীমা ব্যবহার করে আনয়ন করা হয়েছিল।
আটককালে চোরাচালনের মোট ৪৬৩টি বাক্স অস্ত্র উদ্ধার করা হয় যেগুলির মধ্যে ছিল এমটিটি, এসএমজি, টমিগান ৭৯০টি, গ্রেনেড ২৭ হাজার, রকেট লঞ্চার ১৫০, ম্যাগজিন ৬২০ এবং ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৫২০টি গুলি। এগুলির আনুমানিক মূল্য ২৭ হাজার কোটি টাকা। পত্রিকার সংবাদে বলা হয়েছে যে উলফা চীন থেকে ক্রয় করে কিউসি নামীয় জাহাজে করে বাংলাদেশের জলসীমায় নিয়ে আসে এবং দুটি ‘কনটেইনার বোট’-এ করে বাংলাদেশের ভূমিসীমায় অবতরণ করায়। চট্টগ্রাম থেকে স্থলপথে ভারতে উলফার কাছে এ অস্ত্র পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল।
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল তারিখে মধ্যরাতের এই ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয় পাঁচ ব্যক্তিকে। পরদিন ২ এপ্রিল ২০০৪ ভোরে পুলিশ প্রহরায় আটক অস্ত্র চট্টগ্রাম নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সেদিনই আটককৃত অস্ত্র পরিদর্শন করেন। পর দিন ৩ এপ্রিল ২০০৪ তারিখে কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদুর রহমান বাদী হয়ে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(বি) ধারায় এবং ১৮৭৮ সালের ১৯(এ) ধারায় অস্ত্র আইনে দুটি মামলা দায়ের করেছিলেন। তবে তিনি এর এজাহারে কোনো আসামির নাম উল্লেখ করেননি। পরবর্তীকালে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডি পুলিশকে। ২০০৭ সাল হতে প্রসিকিউশন অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান মামলার চার্জ গঠনে জোর তৎপরতা শুরু করে।
অস্ত্র আটক ও চোরাচালান আটকের ঘটনায় ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ২০০৪ সালের ১১ জুন প্রথম দফা ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছর ২০০৭ এর ২৫ আগস্ট সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ মামলা দুটির অধিকতর তদন্ত শুরু হয়।
তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৬ জুন নতুন করে বাবর, নিজামীসহ ১১ জনকে জড়িত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। অস্ত্র আটক মামলায় ৫০ জন এবং চোরাচালান আইনে ৫২ জনকে আসামি করা হয়। ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। অস্ত্র আটক মামলায় ৫৬ এবং চোরাচালান আইনে ৫৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।
এই মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ রাজনীতিবিদ ও সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের জড়িত করা হয়। এদের বেশিরভাগ কর্মকর্তা সরকারের মেয়াদকালের শেষে অর্থাৎ ২০০৬ সালের অক্টোবরের মধ্যে দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
বাবর, নিজামী ও পরেশ বড়ুয়া ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রহিম, পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, এনএসআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কেএম এনামুল হক, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব নুরুল আমিন, অস্ত্র বহনকারী ট্রলারের মালিক হাজি সোবহান, চোরাকারবারি হাফিজুর রহমান এবং অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ।
সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ ও গোয়েন্দা সংস্থা এই চোরাচালানের বিষয়ে অবহিত বা জড়িত ছিলেন বলে ওই সময় অভিযোগ করা হয়। ২০০৫ সালের ৬ জুলাই এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ২০১৪ সালের ১৪ ফ্রেব্রুয়ারী তারিখে আদালত এ মামলার রায় প্রকাশ করে। আদালত সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদান করে।