তাসকিয়ার বয়স সবে দেড় বছর। বাড়িতে লোকজনের ভিড় দেখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে বারবার। কখনও কখনও আধো আধো শব্দে ‘বা বা বাবা….’ এমনটা বলছে। তাসকিয়ার মন ভালো নেই। সদা হাস্যোজ্জ্বল শিশুটির মুখ ভর্তি বিষাদ। চোখের কোণে এই বুঝি জল এলো এলো। বাবাকে হারানোর শূন্যতা তার ছোট্ট হৃদয়কেও যেন নাড়া দিয়েছে। হয়তো পুরো বিষয়টা বুঝতে পারলে হাজার গুণ হতো এই বেদনা। যে ব্যাথায় অকাতরে অস্রু ঝরিয়ে যাচ্ছেন তাসকিয়ার মা, দাদা-দাদি। শোক ছেয়ে গেছে পুরো বাড়ি, পুরো এলাকা এমনকি পুরো দেশে।
বলছিলাম চট্টগ্রামের আদালত প্রাঙ্গণে খুন হওয়া আইনজীবী সাইফুলের পরিবারের চলা শোকের কথা। মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার সদর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের টেন্ডলপাড়া এলাকায় তাদের নতুন বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এমন শোকের দৃশ্য।
সাইফুল ইসলাম আলিফ সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি)। তিনি লোহাগাড়ার চুনতি এলাকার জামাল উদ্দিনের ছেলে। ছাত্রজীবনে তুখোড় মেধাবী ছিলেন সাইফুল। জিপিএ ফাইভ পেয়ে দাখিল পাশ করেছিলেন আধুনগর ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা থেকে। মাদরাসা থেকে দাখিল পাশ করে ইন্টারমিডিয়েট পড়েন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে। সেখানেও মেধার সাক্ষর রাখেন। পরে আর্ন্তজাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) থেকে এলএলবি পাশ করে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। চট্টগ্রাম আদালতে প্র্যাক্টিস করতেন তিনি। আজকেও প্রতিদিনকার মতো পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। তবে ইসকন নেতা চিন্ময় দাশের জামিন নামঞ্জুরের ঘটনায় সংঘর্ষে খুন করা হয় তাকে।
আইনজীবী সাইফুলের ৭২ বছর বয়সী বাবা জামাল উদ্দিন বলেন, আমি কখনো কল্পনা করিনি আমার ছেলে এভাবে আমার আগে চলে যাবে। আমার ছেলে তাহাজ্জুদগুজার ছিল। আমার ছেলে নিয়মিত নামাজি ছিল। বিনা অপরাধে আমার ছেলেকে তারা মেরে ফেলেছে। আমি আমার কলিজার টুকরো ছেলে হত্যার বিচার কার কাছে চাইবো?
তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি কখনো কল্পনা করিনি আমার ছেলে এভাবে আমার আগে চলে যাবে। আমার ছেলে তাহাজ্জুদগুজার ছিল। আমার ছেলে নিয়মিত নামাজি ছিল। বিনা অপরাধে আমার ছেলেকে তারা মেরে ফেলেছে। আমি আমার কলিজার টুকরো ছেলে হত্যার বিচার কার কাছে চাইবো?
সাইফুলের ভগ্নিপতি কাজী মাওলানা বদরুদ্দিন সাদী জানিয়েছেন, তারিন এখন সন্তানসম্ভবা। মঙ্গলবার একদল সন্ত্রাসী কেড়ে নিলো তার স্বামীর জীবন। ভেঙে খানখান হয়ে গেল সোনালী সংসার। প্রাণপ্রিয় স্বামীকে উগ্রসন্ত্রাসীরা জবাই করে হত্যা করেছে এ খবর শোনার পর বেহুঁশ হয়ে গেছেন স্ত্রী তারিন। আইনজীবী সাইফুলরা ৫ ভাই ২ বোন। সাইফুল ছিলেন ৩য়।
সাইফুলের ফুফাতো ভাই মো. মহিউদ্দিন জানান, পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে সাইফুল তিন নম্বর সন্তান। তিন বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। তাদের সংসারে মাসুরা ইসলাম তাসকিয়া নামে দেড় বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
তার বড় মামা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাইফুল ছোটবেলা থেকেই একজন নম্র-ভদ্র স্বভাবের ছিলো। সে দুষ্কৃতকারীর হাতে শহীদ হয়েছেন। পারিবারিকভাবে আমরা খুবই মর্মাহত। এ ঘটনায় আমরা প্রশাসনের কাছে বিচার চাই।
যেভাবে ঘটে আইনজীবী সাইফুল হত্যাকাণ্ড
বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনা সংঘের (ইসকন) নেতা অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার ও আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোকে কেন্দ্র করে আজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে দিনভর সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজনের সংঘর্ষ হয়েছে। এর এক পর্যায়ে সাইফুল ইসলাম নামের এক আইনজীবীকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
ঘটনাপ্রবাহের শুরু গতকাল সোমবার রাতে। রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ডিবি পুলিশ চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেফতার করে। প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল বের করে সনাতনী সম্প্রদায়। এরপর আজ সকাল সাড়ে দশটায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের আদালতে তোলায় হয় এই ইসকন নেতাকে।
এদিন বেলা ১২টার দিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (৬ষ্ঠ) কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে তাকে হাজির করা হয়। এসময় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় আদালত। সনাতনী সম্প্রদায়ের কয়েকশ আইনজীবী ও সমর্থকরা আদালতের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান নেন। শুনানি শেষে জামিন নামঞ্জুর করে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এ খবরে আদালত প্রাঙ্গনে বিক্ষোভ শুরু করে সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজন। চিন্ময় প্রভুকে আদালত থেকে কারাগারের উদ্দেশে প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে তারা প্রিজন ভ্যানের সামনে পেছনে অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। স্লোগানের পাশাপাশি এসময় কেউ কেউ ভ্যানের সামনে শুয়েও পড়েন।
বিক্ষোভের এক পর্যায়ে আদালত চত্বরে থাকা প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন ভাংচুর করতে থাকে সেখানে উপস্থিত বিক্ষোভকারীরা। বিকেল ৩টার দিকে চিন্ময়কে বহনকারী প্রিজন ভ্যান কারাগারের উদ্দেশে এগোতে থাকে। এসময় চিন্ময়ের অনুসারীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। জেলা পরিষদের সঙ্গে সড়ক অবরোধ, যানবাহন ভাংচুর ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ভাংচুর করা হয় আদালত ভবনের মসজিদের জানালার কাচও।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু আইনজীবীরা একত্রিত হয়ে সনাতনীদের ধাওয়া দেয়। এসময় বিক্ষোভকারীরা রঙ্গম সিনেমার গলিতে ঢুকে যায়। সেখানেই আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এসময় তাকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। পুলিশ ও অন্যান্য আইনজীবীরা তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আইনজীবীদের আদালত বর্জন, দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড়
অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম আদালত বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন আইনজীবীরা। বিষয়টি নিশ্চিত করে আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সমিতির সদস্য হত্যার প্রতিবাদে বুধবার আদালত বর্জন করবেন আইনজীবীরা। আমরা এদিন আদালত চত্বরে হত্যার প্রতিবাদে সমাবেশ করব।
এদিকে আইনজীবী সাইফুল হত্যায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনগুলো এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সেই সাথে ঘটনায় জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। – চট্টগ্রাম খবর