কক্সবাজারের পেকুয়ায় সুদ কারবারির ফাঁদে পড়ে এলাকা বাড়ি ভিটা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন অসংখ্য ভুক্তভোগী। স্বল্প আয় ও অর্থ সংকটে থাকা এলাকার সহজ সরল লোকদেরকে বিভিন্ন প্রতারণার ফাঁদে ফেলে কারবারিরা চড়া সুদের আশায় মোটা অংকের টাকা দিয়ে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সরল ভাবে হাতিয়ে নেন স্বাক্ষরিত খালি চেকের পাতা ও নন-জুডিশিয়াল ষ্টাম্প।
আসল টাকার কয়েকগুণ সুদ পরিশোধের পরও আদায় হয়না আসল টাকা ! অপরদিকে সুদ কারবারির হাতে সংরক্ষিত থাকা খালি চেক ও নন- জুডিসিয়াল ষ্টাম্প (ঋণগ্রহীতা সুদেআসলে পরিশোধের পরেও) ফেরত না দিয়ে মামলার হুমকি দিয়ে এলাকা ছাড়া করে দখলে নেন তার বাড়ি ভিটা। এমন অসংখ্য অভিযোগ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও ইউপি সদস্যের কাছে বিচারাধীন থাকলে ও অনেকের সুরাহা মেলেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বারবাকিয়া ইউনিয়নের বুধামাঝির ঘোনা এলাকার এক ব্যক্তি পেশায় সেলসম্যানের কাজে নিয়োজিত পেকুয়ায়। স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে হিমশিমে পড়ে। বাবার অসুস্থতার খরছ বহন করতে গিয়ে বিগত ২০১৫ সালে মগনামা বাজার পাড়া এলাকার এক সুদ কারবারি থেকে খালি ষ্টাম্প দিয়ে পনেরো হাজার টাকা নেন যৌথ ব্যবসার নামে। টাকা নেওয়ার চার মাসের মাথায় সুদ কারবারিকে লভ্যাংশ প্রদান করেন বিশ হাজার টাকার ওপরে। এমতাবস্থায় সুদ কারবারি নিজে থেকে ঋণগ্রহীতাকে অপার করে পূর্বের পনেরো হাজার টাকা ফেরত দিয়ে নতুন করে টমটম বন্ধকের ওপর ৫০ হাজার টাকায় মাসিক ৫ হাজার পাঁচশত টাকা ভাড়া হিসেবে নিতে।
তার পরামর্শ মতে ঋণগ্রহীতা তাই করেন। কিন্তুু নতুন করে ঋণ নিতে পূর্বের কাগজ ফেরত চাইলে ঋণগ্রহীতা- কারবারি সরল ভাষায় সৌহার্দপূর্ণ আচরণ দিয়ে বলেন, তার দোকান চুরি হওয়াতে সব কাগজ পত্র চুরের দল নিয়ে যায়,তোমার কোন সমস্যা হবেনা। দ্বিতীয় লেনদেনে চুক্তি মোতাবেক নয় মাসে ঋণগ্রহীতা ৪৯ হাজার টাকা লাভ জমা দেওয়ার পর বাবার অসুস্থতার কারণে লভ্যাংশ দিতে অক্ষম হলে তিন মাস পরে পূর্বের সেই চুরি হওয়া খালি ষ্টাম্পে ৫০ হাজার টাকা লিখে বলেন আমি তোমার কাছে ৫০ হাজার টাকা পাই। টাকা না দিলে তোমার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিবো। ঠিকই প্রথমে থানায় পরে আওয়ামী লীগ নেতার কাছে সালিশ দেন ওই কারবারি। ভুক্তভোগী এমন পরিস্থিতির বর্ণানা দিতে গিয়ে ফুসলিয়ে কেঁদে উঠে।
এবিষয়ে জানতে ঋণদাতা নুরুল আজিম দায় অস্বীকার করে জানান, আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আমি সুদ কারবারি না সে আমার কাছ থেকে তার বাবা সহ টাকা গুলো ২০১৫ সালে নিয়েছিলো। সে আমার টাকা গুলো দিচ্ছে না।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সুদের রমরমা ব্যবসা যেনো নতুন কিছু নই। মগনামা ইউনিয়নের শরৎ ঘোনা, বাইন্যাঘোনা, ঘাটমাঝির পাড়া এলাকায় সুদ কারবারিদের অত্যচারে সামাজিক মান মর্যাদার ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে।
রাজাখালী ইউনিয়নের পালাকাটা, মৌলভী পাড়া, বকশিয়া ঘোনা, ছড়িঁ পাড়া, বামুলা পাড়া ও বদি উদ্দিন পাড়া এলাকায় সুদের রমরমা বানিজ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কিছু ভুক্তভোগী জানান, ছড়িঁ পাড়া এলাকার শক্তিশালী এক সুদ কারবারি থেকে ৫০ হাজার টাকা নিতে প্রথমেই কারবারির হাত খরছ হিসেবে দশ হাজার টাকা দিয়ে, ৪০ হাজার টাকা নেন দুইটি স্বাক্ষরিত ব্যাংকের চেকের পাতা দিয়ে মাসিক ৬ হাজার টাকা লাভে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুন্দরী পাড়া এলাকার এক ফিশিং বোট ব্যবসায়ী জানান, তাদের খপ্পরে পড়ে এলাকা বাড়ী ভিটা সব ত্যাগ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। তিন লাখ টাকা সুদের ওপর নিতে স্বাক্ষরিত খালি ষ্টাম্প সহ খালি চেক জমা দিতে হয়েছে ১৫ টি। তিন লাখ টাকায় দ্বিগুণ পরিশোধ করার পরেও খালি চেকে বিশ লাখ টাকা লিখে আমার বিরুদ্ধে চেকের মামলা করে ওই প্রতারক সুদ কারবারি।
ছড়িঁ পাড়া এলাকার আবদুর রশিদ নামে এক অভিভাবক জানান, সুদ কারবারি আমার ছেলেকে টাকা দিয়েছে আমাকে না জানিয়ে। এখন ছেলে লাপাত্তা, চড়া সুদের ওপর টাকা দিয়ে আমার বাড়িতে এসে আমাকে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করলে অবশেষে উপায় খুজে না পেয়ে জায়গা জমি বিক্রি করে পরিশোধ করি। তিনি আরো জানান, আশেপাশে অনেকেই সুদ কারবারি, কেউ কেউ ৩০ হাজার টাকায় মাসিক এক বস্তা চাউলের ওপর টাকা লাগায়। আবার কেউ ৫০ হাজার টাকা সুদের ওপর লাগিয়ে দ্বিগুণ লাভ পরিশোধের পরেও জায়গা জমি দখলে নিতে মরিয়া।
এ প্রসঙ্গে জানতে পেকুয়া উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মোস্তফা জামান এ প্রতিবেদককে জানান, পেকুয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সুদ কারবারির অত্যাচারে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ সেটা শুনেছি। গত সমন্বয় মিটিং এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কারো কাছ থেকে স্বাক্ষরিত খালি ষ্টাম্প ও খালি চেক নিয়ে হয়রানি করা আইনগত অপরাধ। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই প্রসঙ্গে পেকুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোহাম্মদ সিরাজুল মোস্তাফা দৈনিক ইনকিলাব কে জানান, কেউ লাভের ওপর টাকা দিয়ে কৌশলে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে স্বাক্ষরিত চেকের পাতা ও নন-জুড়িসিয়াল খালি ষ্টাম্প নিলে, এক্ষেত্রে কেউ হয়রানি হয়ে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।