বেতনের বাইরে ১৩৪ কোটি টাকা পাওয়া গেলো মুন্নী সাহা অ্যাকাউন্টগুলোতে— সংবাদের এমন সব শিরোনামে ওঠে এসেছেন সাংবাদিক মুন্নী সাহা। প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদে দাবি করা হয়েছে— বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালানোর পর পরই এসব আমানতের মধ্যে ১২০ কোটি টাকাই উত্তোলন করা হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ‘সূত্রে’র বরাত দিয়ে এসব সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার দুদিন আগে শনিবার রাতে রাজধানীর কারওয়ানবাজার থেকে সাংবাদিক মুন্নী সাহাকে আটক করে পুলিশ। তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোবারক হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সাংবাদিক মুন্নী সাহা রাত ১০টার দিকে জনতা টাওয়ারের অফিস থেকে বের হওয়ার পর স্থানীয় কয়েকজন তাকে ঘিরে ধরেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। পরে অবশ্য ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে নেওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মাত্র দুদিন পর মুন্নী সাহার ব্যাংক একাউন্টের ‘তথ্য’ নিয়ে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরগরম, তখন তিনি নিজে পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে জানালেন তাকে জড়িয়ে যা কিছু বলা হচ্ছে, তার পুরোটাই অসত্য ও বিভ্রান্তিকর।
মুন্নী সাহা বলেন, যে ব্যাংক একাউন্টের কথা বলা হচ্ছে, সেটি মূলত তার স্বামীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের। নমিনি হওয়া ছাড়া যে একাউন্টের সঙ্গে তার কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই।
তিনি বলেন, অ্যাকাউন্টে ১৩৪ কোটি টাকা জমা হয়েছে বলে যে দাবি করা হয়েছে সেটি ভুল। আসলে এই পরিমাণ টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ লেনদেনই এমএস প্রমোশনের। এই হিসাবের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি শুরুর পর থেকে এর ব্যবসায়িক লেনদেন, কর্মীদের বেতন সবকিছু রয়েছে।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান ‘এমএস প্রমোশনের’ মালিক কবির হোসেন তাপস। তিনি মুন্নী সাহার স্বামী।
প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদে গুলশান-তেজগাঁও লিংক রোড এলাকায় নিকেতনে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি থাকার কথাও এসেছে। এ প্রসঙ্গে মুন্নী সাহা বলেন, ১২৬টি ফ্ল্যাটনিয়ে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের মালিকানাধীন একটি সোসাইটিতে কিস্তিতে একটি ফ্ল্যাট কেনেন। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর ধরে কিস্তি দেওয়ার পর তিনি ফ্ল্যাটটিতে ওঠেন।
পরিবারসূত্রে নমিনি, মালিক নয়
দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মিসলিডিং হেডলাইন দেখে বিস্মিত হওয়ার কথা জানিয়ে মুন্নী সাহা বলেন, ‘অনেকেই আমার একাউন্টে ১৩৪ কোটি টাকা- এমন ফটোকার্ড বানিয়ে ক্লিক নিচ্ছেন। ‘মুন্নী সাহার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একাউন্ট’ বলে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করা হচ্ছে যাতে জনমনে ধারণা হচ্ছে এই একাউন্টগুলো আমার। কোনো একাউন্টের নমিনি হলে সেটি ‘স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একাউন্ট’ বলে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করা যায়, কিন্তু সেই একাউন্টগুলো যে আমার নয়, সেটি কৌশলে এড়িয়েও যাওয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘কবির হোসেন তাপস দেশের একজন পুরনো ব্যবসায়ী। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে তিনি বিজ্ঞাপন ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত। ওয়ান ব্যাংকের যে একাউন্টটির কথা বলা হয়েছে, আমি সেই একাউন্টের একজন নমিনি মাত্র; একাউন্টের লেনদেনের সাথে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কবির হোসেন তাপসের কোন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে আমি অংশীদার নই, কোন একাউন্টের গ্যারান্টারও নই। একাউন্ট ওপেন করার সময় পরিবারের কাউকে নমিনি হিসেবে দিতে হয় বলে এই একাউন্টে আমার নাম দেওয়া আছে মাত্র।’
জমা নয়, ৭ বছরে ‘লেনদেন’ ১৩৪ কোটি টাকা
‘১৩৪ কোটি টাকা একই সাথে একাউন্টে জমা ছিল’— এমন তথ্যের পুরোটাই অসত্য দাবি করে মুন্নী সাহা বলেন, ‘আলোচিত একাউন্টটি ২০১৭ সালে খোলা হয়েছে এবং বিগত ৭ বছরে এই একাউন্টে ১৩৪ কোটি টাকা ‘লেনদেন’ হয়েছে। ‘লেনদেন’-এর মানে আমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই বোঝেন, এর মানে হচ্ছে প্রতিটি কার্যাদেশের বিপরীতে সব টাকা এখানে জমা হয় এবং সেই টাকা থেকে বিভিন্ন সাপ্লায়ার, ভেন্ডর, সরকারি কর ও ভ্যাট, কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য অপারেটিং খরচ পরিশোধ করা হয়। এই হিসাবে ৭ বছরে এই একাউন্টে মোট ১৩৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, যা গড়ে মাসে ৬৫ লাখ টাকার মতো। একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে মাসে ৬৫ লাখ টাকার ব্যবসা করা অস্বাভাবিক নয়, এবং সেই টাকার বড় অংশই টাকা বিভিন্ন সাপ্লায়ার, ভেন্ডর, অফিস খরচ, কর্মচারিদের বেতন-ভাতা, ভ্যাট ও কর হিসেবে খরচ হয়, যাকে এখানে ‘লেনদেন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু খবরে এমনভাবে বিষয়টি প্রচার করা হচ্ছে যাতে মনে হয় ১৩৪ কোটি টাকা একই সাথে এখানে জমা ছিল, যা সত্যের অপলাপ।’
টেলিভিশন সাংবাদিক ও টকশো সঞ্চালক মুন্নী সাহা আজকের কাগজ ও ভোরের কাগজে দীর্ঘ সময় কাজ করার পর একুশে টেলিভিশনে যোগ দেন। এরপর যান এটিএন বাংলায়। সেখান থেকে এটিএন নিউজে যোগ দেন তিনি। ২০২৩ সালের ৩১ মে তিনি এটিএন নিউজ থেকে পদত্যাগ করেন। পরে ‘এক টাকার খবর’ নামে একটি প্লাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হন।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গুলিতে শিক্ষার্থী নাঈম হাওলাদার (১৭) নিহতের মামলায় আরও অনেকের সঙ্গে আসামি করা হয় মুন্নী সাহাকেও।