মহেশখালীর মাতারবাড়ি ষাইটপাড়ার রাজিয়া, বয়স ৫৫, সাগরপানে চেয়ে আছেন—শূন্য চোখে। তার এই দৃষ্টিতে রয়েছে ভয়, হাহাকার, আর এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের করুণ বাস্তবতা। ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে সাগরের গর্জন তার মনে বয়ে আনে পুরোনো ক্ষত—যে ক্ষত ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসে দুইবার তার ঘর কেড়ে নিয়েছিলো।
* ৬০ এর দশকে নির্মিত বেড়িবাঁধ
* আতঙ্কে থাকে উপকূলের ২০ লাখ মানুষ
ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র সংকেত তার মনে আবারো এক ভয়াবহ শঙ্কা তৈরি করেছে। এর আগেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার সামান্য কুঁড়েঘরটি দুবার ধ্বংস করে দিয়েছিলো। প্রথমবার ঘর হারিয়ে স্বামীর সঙ্গে কঠিন সংগ্রাম করে টিকে ছিলেন। কিন্তু ১৫ বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে একাই বেঁচে আছেন তিনি। সংসারে একমাত্র মেয়ে ছিল, তারও বিয়ে হয়ে গেছে। এখন একা একাকী ছোট্ট ঘরটিতে দিন কাটে তার।
এই বয়সে এসে বেঁচে থাকার লড়াইটা সহজ নয় রাজিয়ার জন্য। মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনোরকমে দিন কাটান। কিন্তু তারও একটা চাওয়া ছিল, কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সা নয়—শুধু একটা বেড়িবাঁধ। এই বেড়িবাঁধটি হলে হয়তো তার ঘর, তার শেষ আশ্রয়স্থলটি সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে আর ভেঙে যাবে না। গতকাল বৃহস্পতিবার মাতারবাড়ি ষাইটপাড়ার জিওব্যাগের উপর বসে এসব কথা জানান তিনি।
রাজিয়া কষ্ট নিয়ে বলেন, “কারো কাছে কিছু চাইনি, শুধু একটা বেড়িবাঁধ চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা আর হলো না। আবার ঝড় আসছে, জানি না এবার কি হবে। আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি।”
রাজিয়ার মতো আরও অনেকেই এমন দুর্যোগের মুখে অশান্তি নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। মাতারবাড়ি ষাইটপাড়া এলাকার মানুষেরা যেমন প্রায়শই এমন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মুখোমুখি হয়। তেমনই উপকূলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ দুর্দশায় আতঙ্কে কাটে। কিন্তু একটার পর একটা দুর্যোগ পেরিয়ে তারা টিকে থাকলেও, তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানিয়েছেন, “কক্সবাজার উপকূলজুড়ে ৫৯৫ কি.মি বেড়িবাঁধ ৬০ দশকে নির্মিত হয়েছিলো, তবে এখনো সংস্কার হয়নি নতুন করে”।
সে সময় সাগরের উচ্চতার ওপর নির্ভর করে তৈরি করা এ বেড়িবাঁধ জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে সাগরের উচ্চতা বাড়লেও নতুন করে নির্মিত হয়নি আর। জোড়াতালির বেড়িবাঁধে আতঙ্কে আছে উপকূলের ২০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৮০ কি.মি জুড়ে বেড়িবাঁধের শুধু চিহ্ন আছে। বাকি অংশটুকুও নতুন করে সংস্কার হয়নি। এই বেড়িবাঁধ না থাকায় লবণ, চিংড়ি ঘেরের ও ক্ষেতের লাখ লাখ টাকা ক্ষতি হয় উপকূলের মানুষের।
রাজিয়ার ভয়, আশঙ্কা, আর অসহায়ত্ব যেন প্রকৃতির কাছে কৌতুক। তার মতো বৃদ্ধা যারা জীবনের শেষপ্রান্তে এসে একটু শান্তির আশায় দিন কাটাচ্ছেন, তারা আবারও প্রাকৃতিক দুর্যোগের নির্মমতায় নিজের সামান্য আশ্রয়টুকু হারানোর আশঙ্কায় আছেন।
যদিও রাজিয়া অন্যের বাড়িতে কাজ করে নিজের আহার যোগান। তার স্বপ্ন ছিল শুধু একটি মজবুত বেড়িবাঁধের। সেই স্বপ্ন হয়তো আর পূরণ হবে না।
প্রকৃতির সঙ্গে রাজিয়ার এ সংগ্রাম আমাদের কাছে শুধু দুঃখের কাহিনী নয়, বরং এটা আমাদের দায়িত্ববোধের এক নির্মম চিত্র। রাজিয়ার মতো অসংখ্য মানুষ ঘর হারিয়েছেন। অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র ঘর বেঁধেছে। ঘরহারা মানুষগুলো তাদের জীবনের লড়াইয়ে আরও একবার পরাজিত হতে যাচ্ছেন।
রাজিয়া যেমন সাগরের দিকে তাকিয়ে তার ভাগ্যকে মেনে নিচ্ছেন, তেমনি আমাদের উচিত এসব অসহায় মানুষদের জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তোলা। – টিটিএন ডেস্ক